প্রকাশিত: ২২/০৮/২০১৮ ৬:০৪ পিএম

উখিয়া নিউজ ডটকম::
নিজ দেশের বাইরে প্রথমবারের মতো কোরবানির ঈদ কেটেছে রোহিঙ্গাদের। গতবছর এই দিনে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপরে দেশটির সেনাবাহিনী বর্বর নির্যাতন চালায়। ফলে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে পালাতে থাকেন। ঈদের দিনে কেউ পাহাড়ে, কেউ সাগরে, আবার কেউবা সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়েন বাংলাদেশে। অনেকে হারিয়েছেন বাবা-মা, কেউ আদরের সন্তান,আবার কেউবা ধর্ষণের শিকার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পালিয়ে আসেন। সহায় সম্বল হারানো এই রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ অঞ্চলে।

বিশ্বে নজির বিহীন নির্যাতনের শিকার এই রোহিঙ্গারা আজ (বুধবার) শরণার্থী শিবিরে ঈদ উদযাপন করেছেন চোখের জলে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঈদের নামাজ আদায়ের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন ইমাম ও মুসল্লিরা। মসজিদে মসজিদে মোনাজাতে অংশ নেন লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম। নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও মর্যাদার সঙ্গে রাখাইনে ফিরে যাওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন তারা।এছাড়া, কোরবানির ঈদে সঠিক সময়ে কোরবানির পশু জবাই,পরিমাণ মতো মাংসও পাননি রোহিঙ্গারা।এজন্য হতাশাও প্রকাশ করেছেন তাদের অনেকে।

কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং টিভি টাওয়ার সংলগ্ন বটতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘একব্যক্তি আমাদের দুই মাঝির জন্য একটি ছোট্ট কোরবানির গরু দান করেছেন। জবাইয়ের পর আনুমানিক ৮০ কেজির মতো মাংস হয়েছে। প্রায় ৪০০ পরিবারের মধ্যে এই মাংস ভাগ করে দেওয়া হয়। এতে প্রতি পরিবার আড়াই শত গ্রাম (এক পোয়া) করে মাংস পেয়েছে।’
একই ক্যাম্পের আরেক রোহিঙ্গা মাঝি মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘গত বছর কোরবানির ঈদের নামাজ আদায় করতে পারিনি। আজকের এই দিনে আমরা ছিলাম রাখাইনের একটি পাহাড়ি জঙ্গলে। তবে এবার কোরবানির মাংস খেতে না পারলেও ভালো লাগছে। কারণ, বাংলাদেশে এসে অন্তত ভালো করে ঈদের নামাজটি আদায় করতে পেরেছি।’

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মোহাম্মদ লালু মাঝি বলেন, ‘রাখাইনে বর্বর ও নানা নির্যাতনের শিকার হলেও নিজ দেশের জন্য মায়া হয় আমাদের। আমরা চাই, নিরাপদে রাখাইনে ফিরতে। আজকে ঈদ জামাত শেষে আল্লাহর কাছে এই ছিল প্রার্থনা। কারণ, এই ছোট পরিসরে আমাদের জীবন বিষাদ হয়ে উঠেছে। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। নেই কোনও আনন্দ।’

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আয়ুব আলী মাঝি বলেন, ‘আজকে ঈদের নামাজ শেষে শুধু ইমাম, মৌলভীরা নয়, মসজিদে উপস্থিত কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। রাখাইনে আমরা কেউ বাব-মা ও বোনকে হারিয়েছি, আবার কেউ ভাই ও স্বজনকে হারিয়েছি। কবরে পড়ে রয়েছে আমার মা। অন্তত তাদের জন্য হলেও কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কারণ, একবছর হয়ে যাচ্ছে আমরা বাংলাদেশে এসেছি। এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কোনও সংস্থা আমাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারেনি।’

উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আট নম্বর ব্লকের বাসিন্দা খালেদা বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘রাখাইন থেকে পালিয়ে আসার সময় আমি আমার পিতাকে হারিয়েছি। আজ তিনি নেই। এই প্রথম আমার বাবাকে ছাড়া ঈদ করলাম। তাও নিজ দেশে করতে পারলাম না। আল্লাহ কেন আমাদের প্রতি এত অবিচার করেন।’

কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা রোহিঙ্গা যুবক আবু তাহের বলেন, ‘আমরা সামান্য পরিমাণ কোরবানির মাংস পেলেও ক্যাম্প-১ এর সি-ব্লকের রোহিঙ্গারা মাংস বলতে চোখেও দেখেনি। কোনও এনজিও এবং সংস্থা সেখানে গরুর মাংস বিতরণ করেনি।’

রাখাইনে প্রতিবছর ধুমধাম করে ঈদ উদযাপন করতেন এই রোহিঙ্গারা। আজ তাদের পাশে কেউ নেই। নিজ দেশ ছেড়ে তারা আজ ভিন দেশের বাসিন্দা। আজকের দিনটি খুশি ও আনন্দের হলেও রোহিঙ্গাদের জন্য ছিল বেদনার। পবিত্র এই দিনে বৃষ্টিভেজা সকালে ক্যাম্পে অবস্থিত ছোট ছোট মসজিতে ঠাসাটাসি করে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন তারা। নামাজ শেষে মোনাজাতে আল্লাহর কাছে একটিই প্রার্থনা ছিল তাদের— যত দ্রুত সম্ভব তারা যেন নিজ দেশ রাখাইনে ফিরে যেতে পারেন। রাখাইনে যাতে শান্তি ফিরে আসে। নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে যেন তাদের পিতা-মাতা, দাদা-দাদিসহ আত্মীয়-স্বজনদের কবর জিয়ারত করতে পারেন।আজকে ঈদ জামাতে অধিকাংশ মসজিদের ইমামরা রাখাইনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন।

জানতে চাইলে কক্সবাজারের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনজার্চ মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘ক্যাম্পে কর্মরত এনজিও’রা রোহিঙ্গাদের মাঝে পর্যাপ্ত সংখ্যক কোরবানির পশু বিতরণ করার কথা ছিল। ধারণা করেছিলাম যে, প্রতি রোহিঙ্গা পরিবার অন্তত দুই কেজি করে মাংস পাবে। কিন্তু সময় মতো এনজিও’রা কোরবানির পশু বিতরণ করতে পারেনি। যেসব এনজিও কোরবানির পশু দান করেছে তা ছিল অপ্রতুল। ছোট আকারের গরু হওয়ায় রোহিঙ্গাদের মাঝে মাংস বিতরণে হিমসিম খেতে হয়েছে।’

উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘রাখাইন থেকে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৬ হাজার ৪১৭ জন। এদের অধিকাংশ উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে। এবার কোরবানির ঈদ হচ্ছে দেশের বাইরে তাদের প্রথম ঈদ। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মাঝে যেভাবে কোরবানির পশু বিতরণ হওয়ার কথা ছিল, আমরা সেভাবে পারিনি। কারণ, এনজিও’রা আমাদের ধোকা দিয়েছে। এরপরও আমরা সাধ্য মতো মাংস দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মাঝে যথা সম্ভব কোরবানির মাংস বিতরণ করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত বিভিন্ন এনজিও, সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে কোরবানির পশু দান করেছে। কোরবানির নামাজের পরপরই এসব পশু জবাই করে রোহিঙ্গাদের মাঝে মাংস বিতরণ করা হয়েছে। তবে যেভাবে দেওয়ার কথা ছিল, তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।’

গত বছরের ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংস ঘটনায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে আসে প্রায় ১১ লাখ ১৬ হাজার ৪১৭ জন রোহিঙ্গা। এই রোহিঙ্গাদের অভিযোগ— প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা রাখাইনে বসবাস করলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের বীজ বপন করেছে। ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র,কখনও নীলচে রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরংয়ের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন নাগরিকে। এই মানুষগুলো এখন অপেক্ষায় আছেন নিরাপদ প্রত্যাবাসনের। খবর.বাংলা ট্রিবিউনের

উল্লেখ্য, কক্সবাজারের ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থিত ১০২০টি মসজিদ ও ৫৪০টি নূরানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মত্তব) ও টেকনাফের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঁচটি, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২৪৫টি মসজিদ ও ২০টি নূরানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মত্তব) রয়েছে। এসব মসজিদ ও নূরানি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঈদের জামাত আদায় করেছেন শরণার্থী রোহিঙ্গারা।

পাঠকের মতামত